শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক জীবনী ও রাজনীতি


 


 শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক এর  রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিবরণ:

পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক, পিতা কাজী ওয়াজেদ আলী ও মাতা সায়েদুন্নেছা খাতুন, তিনি একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারত বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশালের ঝালকাঠি বাংলাদেশে) জন্ম গ্রহণ করেন৷ তার পিতা ছিলেন একজন স্বনামধন্য আইনজীবি৷ ফজলুল হক ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন তার পর ১৮৯৭ আইন পেশা ডিগ্রী অর্জন করে তার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে৷ 

তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, ফজলুল হক ব্রিটিশ ভারতের অতঃপর পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন৷ 

শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক এর রাজনৈতিক দল ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি৷ ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য হয়ে প্রধান মন্ত্রী হন৷ তিনি প্রজাগণের উপর জমিদারদের প্রভাব কমানোর জন্য ১৯১৫ সালে কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেন৷ ১৯১৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন৷ তার পর  ১৯১৭ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।

ইতিহাসের তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একই সাথে মুসলিম লীগ এর সভাপতি এবং কংগ্রেস এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন ।

 ১৯৩৭ এর নির্বাচনে শেরে বাংলা  ফজলুল হক ঘোষণা দিয়েছেন নির্বাচনে জিতলে তিনি জমিদারি প্রথা চিরতরে উচ্ছেদ করবেন।

 ১৯৪০ সালে ফজলুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে লাহোর প্রস্তাব প্রবর্তিত করেন৷তিনি তার প্রস্তাবে বলেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বাস্তবতায় হিন্দু মুসলিম একসাথে বসবাস অসম্ভব। সমাধান হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র এবং পূর্বাঞ্চলে বাংলা ও আসাম নিয়ে আরেকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

 লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের সময়ে হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলোতে মুসলিম নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকার কারণে ফজলুল হক খুবই উদ্বিগ্ন এবং কিছুটা উত্তেজিত ছিলেন। তিনি তার বক্তব্যে একবার বলেন, ‘আমি আগে মুসলিম, পরে বাঙালী (Muslim first, Bengali Afterwards)’। বক্তৃতার এক পর্যায়ে এসে বলেন, ‘কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলোতে যদি আর কোনো মুসলিম নির্যাতিত হয় তাহলে আমি বাংলার হিন্দুদের উপর তার প্রতিশোধ নেব।’

বর্তমানে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র তার ভিত্তি হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব। তাই ২৩ শে মার্চ কে পাকিস্তানে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক ঢাকা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হয়ে একুশ বছর কাউন্সিলের দায়িত্ব পালন করেন৷ তার জীবনের প্রায় পঞ্চাশটি বছর অবিভক্ত ভারতীয় মুসলমানদের পৃথক জাতি গঠনের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন৷ ফজলুল হক সারা বাংলাদেশে 'শেরে বাংলা অর্থাৎ বাংলার বাঘ' নামে পরিচিত৷ তার পর তার ডাক নাম হয় শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক৷সাধারণ মানুষের নিকট তিনি "হক সাহেব" নামেও পরিচিত ছিলেন ।

ফজলুল হক এর দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন খুরশিদ বেগম জান্নাতুন্নিছা বেগম খাদিজা৷ শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারত এবং ১৯৫৬-১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর নাগরিকত্ব ছিলেন৷ 

 কলকাতার বাবুরা বলেছেন,"ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় করার কোন দরকার নেই। ফার্মগেট আছে,ধানমণ্ডি আছে পাশে একটা কৃষি কলেজ করে দাও। "

এই ধরনের কায়েমী স্বার্থবাদী আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশ লর্ডের কাছে গিয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হক বোঝালেন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। এবার ব্রিটিশরা কিছুটা নমনীয় হল-- কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল একটু দেরীতে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক । 

ফজলুল হক জানতেন মাঝখানে ভারতকে রেখে পশ্চিম আর পূর্বে জোড়া দিয়ে এক পাকিস্তান করলে তা কখনো টিকবে না। ‘জিন্নাহ আমার লাহোর প্রস্তাবের খৎনা করে ফেলেছে বলে ফজলুল হক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় থাকেননি।

১৯৪৬ এ এসে জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীর দুই বাংলা একত্র করে স্বাধীন যুক্তবাংলার দাবী মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাও ভাগ করতে হল।

ফজলুল হক বলেছিলেন, একটি পাকিস্তান কখনও টিকবে না। বাংলা এবং আসামকে নিয়ে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র করতে হবে।

১৯৭১ সালে এসে দেখা গেল, ফজলুল হকের আশঙ্কা এবং ভবিষ্যতবাণী সঠিক। ১৯৭১ এর মত এমন কিছু যে ঘটবে শেরে বাংলা ফজলুল হক তা আঁচ করতে পেরেছিলেন ১৯৪০ সালেই। তাই তিনি ১৯৪০ সালেই বাংলা আর আসাম নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। 

১৯৭১ এর যুদ্ধ হল ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। লাহোর প্রস্তাব ফজলুল হক যেভাবে উত্থাপন করে ছিলেন সেভাবে মানলে একাত্তরে এই দেশে রক্তগঙ্গা বইত না।

মহাত্মা গান্ধী র নাতি রাজমোহন গান্ধী তার বইতে লিখেছেন- তিন নেতার মাজারে তিনজন নেতা শায়িত আছেন যার মধ্যে দুজন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন । একজনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি, অথচ তিনিই ছিলেন সত্যিকারের বাঘ । 

কিন্তু এটা তার জীবনের কোনো অপূর্ণতা নয়, একমাত্র রাষ্ট্রপতি হওয়া ছাড়া সম্ভাব্য সব ধরনের পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে । তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব বাংলার তৃতীয় মুখ্য মন্ত্রী; পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পূর্ব- পাকিস্তানের গভর্নর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর । 

 সর্বভারতীয় রাজনীতি ছেড়ে শুধু পূর্ববাংলার রাজনীতি কেন করছেন এই প্রশ্নের উত্তরে ফজলুল হক বলেছিলেন- এরোপ্লেন এ উঠলে নিচের জিনিস ছোট আর ঝাপসা দেখাতে পারে, তাই আমি মাটিতেই থাকছি । রাজনীতির এরাপ্লেন এ না চড়লেও সৌদি বাদশাহ সউদ ফজলুল হকের সাথে একটা মিটিং করার জন্য নিজের ব্যক্তিগত বিমান পাঠিয়েছিলেন ফজলুল হককে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।

অসীম সাহসী এই মানুষটি আমাদেরকে সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন। বাঙালী জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই । তিনি বলেছেন, যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা কিভাবে শিখবে ? 

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন ফজলুল হকের শিক্ষক। আবুল মনসুর আহমদের সাথে আলাপচারিতায় ফজলুল হক সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মন্তব্য:

'ফযলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙ্গালী।সেই সঙ্গে ফযলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান।খাঁটি বাঙ্গালীত্বের সাথে খাটি মুসলমানত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফযলুল হক আমার ছাত্র বলে বলছিনা, সত্য বলেই বলছি।খাঁটি বাঙ্গালীত্ব ও খাটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙ্গালীর জাতীয়তা'

পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটি, বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা এই ফজলুল হকের অবদান । কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ফজলুল হক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন কারণ কৃষক- শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ এই উপমহাদেশে মাত্র একজন ব্যক্তি কৃষকদের জন্য রাজনীতি করেছেন । তিঁনি হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক । 

১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললে ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ করে। জিন্নাহ ছাত্রদের সাথে বৈঠকও করেন। কিন্তু ছাত্ররা ছিল নাছোড়বান্দা। জিন্নাহর ধারণা হলো, ফজলুল হক ছাত্রদেরকে উসকানি দিচ্ছেন। ফজলুল হকের বুদ্ধিতে ছাত্ররা উর্দুর বিরোধিতা করছে। জিন্নাহ এবার ফজলুল হকের সাথে দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু ফজলুল হক দেখা করতে রাজি হলেন না। ফজলুল হক জিন্নাহকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন।

জিন্নাহর পীড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন ফজলুল হক। বন্ধ দরজার আড়ালে কথা হয়েছিল দুই মহান নেতার। কিন্তু ইংরেজিতে কী ধরনের বাক্য বিনিময় হয়েছিল তাদের মধ্যে পরবর্তীতে তা লিখেছেন ফজলুল হকের একান্ত সহকারী আজিজুল হক শাহজাহান-

জিন্নাহ : পাকিস্তান তো তুমি কোনোদিন চাওনি। সব সময়ে বিরোধিতা করে এসেছো।

হক : প্রস্তাবটি তো আমিই করেছিলাম। পরে ওটার খতনা করা হয়েছে। আমি এটা চাইনি।

জিন্নাহ: পাকিস্তানের এই অংশ বেঁচে থাক তা তুমি চাও না। তাই ভারতের কংগ্রেসের টাকা এনে ছাত্রদের মাথা খারাপ করে দিয়েছ। তারা আমাকে হেস্তনেস্ত করছে।

হক: আমি এখানে কোনো রাজনীতি করি না। হাইকোর্টে শুধু মামলা নিয়ে চিন্তা করি। আইন আদালত নিয়ে থাকি ।

জিন্নাহ : জানো, তুমি কার সাথে কথা বলছো ?

হক: আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে কথা বলছি।

জিন্নাহ: নো নো, ইউ আর টকিং উইথ দ্য গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান ।

হক: একজন কনস্টিটিউশনাল গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা আমি জানি।

জিন্নাহ: জানো, তোমাকে আমি কী করতে পারি ?

হক: (ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে) তুমি আমার এ্যাই করতে পারো। মিস্টার জিন্নাহ, ভুলে যাওয়া উচিত নয় এটা বাংলাদেশ এবং তুমি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে কথা বলছ।

(আজিজুল হক শাহজাহানের কলাম, অমরাবতী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৪৬-৪৭)

শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক- ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল (৮৮ বছর) বয়সে মৃত্যু বরণ করেন 

পূর্ব  পাকিস্তান ঢাকা (বর্তমান ঢাকা বাংলাদেশ)

  সমাধিস্থল :- তিন  নেতার মাজার

(((((অবিসংবাদিত নেতা বাংলার বাঘ)))

 

.পদ্মা সেতু সম্পর্কে ধারণা ও সাধারণ জ্ঞান

. কম্পিউটার বাংলা টাইপিং সিট

 

 

 

 

ভালো লাগলে পোস্টটি শেয়ার করুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url