মুসলিম ফারায়েজ আইন

 

 
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) বলছেন, "উত্তরাধিকার আইন তোমরা নিজে জানো এবং অপরকে শেখাও সকল জ্ঞানের অর্ধেক হলো এই জ্ঞান" 
 
আমরা মুসলিম হবার পরেও অনেকেই উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অবগত নই৷ এটা প্রত্যেক মুসলমানদের জানা একান্ত প্রয়োজন৷ মুসলিম শরিয়া আইনে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমার উপর নির্ভর করে একজন মুসলমান ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি তার পরবর্তী ওয়ারিশ, উত্তরাধিকারীগণের মাঝে বন্টন করা হয়ে থাকে৷ মুসলিম শরিয়া আইন মোতাবেক মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির এই বন্টন কে ফারায়েজ বলে থাকে৷ 
পবিত্র কোরআন মাজিদে এই সম্পর্কে সূরা নিসাতে খুব জোর দিয়ে বলা হয়েছে৷ তাই এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা জরুরী৷ এতে কোনো মুসলিম পুরুষ বা নারী ব্যক্তি উত্তরাধিকার আইন সূত্রে ফারায়েজ মোতাবেক তার ভাগে কি পরিমাণ সম্পত্তি পাবে সেই বিষয়ে জানা যাবে৷ 
 
এখানে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, এবং পুত্র ও কন্যার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হিস্যা বা অংশ নিয়ে আলোচনা করা হলো- 
 

      মুসলিম উত্তরাধিকার আইন

 
তার আগে জেনে নেই কোনো মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি ভাগ বন্টনের পূর্বে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে যা
 
* মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি হতে তার দাফন কাফনের যাবতীয় খরচ ব্যয় করতে হবে যদি মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকে৷ 
 
* মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকাবস্থায় তিনি যদি কোন ঋণ বা ধার-দেনা করে থাকেন সেগুলো তার সম্পত্তি হতে পরিশোধ করতে হবে৷ 
 
* মৃত ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীর মোহরনা/ দেন মোহর জীবিত থাকতে পরিশোধ না করে থাকেন তবে তার সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করতে হবে৷ জীবিত থাকা কালিন যদি আংশিক পরিশোধ করে থাকে তবে তার অবশিষ্ঠ পরিশোধ করতে হবে৷ 
 
* তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় যদি কোন দান, অছিয়ত/উইল করে থাকেন তা সঠিকভাবে বন্টন করতে হবে৷  

উপরোক্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার পর মৃত ব্যক্তির বাকি সম্পত্তি মুসলিম উত্তরাধিকার আইন মোতাবেক তার পরবর্তী ওয়ারিশদের মাঝে বন্টন করতে হবে৷ 

সম্পত্তির বন্টন 


১) মৃত স্বামীর অংশ হইতে স্ত্রীর প্রাপ্য: একজন বিধবা মুসলিম নারী কখনো তার স্বামীর সম্পত্তির অংশ হতে বঞ্চিত  হবেন না । একজন নারী দুইভাবে তার মৃত স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকেন । মৃত ব্যাক্তির যদি সন্তানাদি ও পুত্র সন্তান থাকে তবে স্বামীর সম্পত্তি হতে স্ত্রী .১২৫ হিস্যা অনুপাতে ১/৮ অংশ ভাগ পাবে৷ আর যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকে তবে স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি হতে .২৫০ হিস্যা অনুপাতে ১/৪ অংশ পাবে৷ মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী হলে সবাই মিলে ১/৪ অংশ সমান ভাগে পাবে৷ 

২) মৃত স্ত্রীর অংশ হইতে স্বামীর প্রাপ্য : মৃত স্ত্রীর অংশ হতে স্বামী কখনো বঞ্চিত হবেন না৷ মৃত স্ত্রীর অংশ নিয়ে আমাদের সমাজে নানান দ্বিধাদ্বন্দ তৈরি হয়ে থাকে৷ মৃত স্ত্রীর সন্তানাদি থাকলে স্বামী ১/৪ অংশ পাবে৷ আর মৃত স্ত্রীর যদি সন্তান বা পুত্র সন্তান না থাকে তাহলে মৃত স্ত্রীর অংশ হতে ১/২ অংশ ভাগ পাবেন স্বামী৷ 
৩) মৃত সন্তানের অংশ হতে পিতার প্রাপ্য : মৃত সন্তানের উত্তরাধিকার সূত্রে পিতা তিনভাবে ভাগ পেয়ে থাকেন৷ যদি মৃত সন্তানের পুত্র, পুত্রের পুত্র বা পুত্রের পুত্রের পুত্র অর্থাৎ তার নাতী, নাতনী পরবর্তী ওয়ারিশ যতই হোক, তখন পিতা তার মৃত সন্তানের অংশ হতে ১/৬ অংশ পাবেন৷ 
যদি মৃত সন্তানের শুধু কন্যা সন্তান বা পুত্রে কন্যা সন্তান থাকে তাহলে পিতা তার মৃত সন্তানের সম্পত্তি হতে ১/৬ অংশ ভাগ পাবেন৷ আর যদি মৃত ব্যক্তির পিতা বা সন্তানাদি না থাকে কেউ না থাকে তবে তার সম্পত্তি জীবিত ভাই, ভাতিজারা ভাগ পেয়ে থাকেন৷
৪) মৃত সন্তানের অংশ হতে মাতার প্রাপ্য: মাতা তার মৃত সন্তানের সম্পত্তি ৩ ভাবে পেয়ে থাকেন । মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নেরই হোক থাকলে অথবা যদি মৃত ব্যক্তির আপন, পূর্ণ বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাইবোন থাকলে তবে মাতা  ১/৬ অংশ ভাগ পাবেন।
মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে এবং মৃত ব্যক্তির যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা ১/৩ অংশ ভাগ পাবেন । কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুইজন ভাইবোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে, তার ১/৩ অংশ মাতা পাবেন । মৃত ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন ।
৫) মৃত পিতার অংশ হতে পুত্র ও কন্যার প্রাপ্য : মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলেরা সকল ক্ষেত্রেই সম্পত্তি পায়। যেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ছেলে ও মেয়ে রয়েছে সেই ক্ষেত্রে ছেলে বা ছেলেরা, মেয়ে বা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুন সম্পত্তি পাবে। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে মাতাপিতা ও স্বামী-স্ত্রী নির্দিষ্ট সম্পত্তি পাওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্টন করা হবে। তবে মেয়ে না থাকলে অংশীদারদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে বাকি সম্পূর্ণ সম্পত্তি ছেলে বা ছেলেরাই পাবে ।
৬) কন্যা সন্তানের প্রাপ্য অংশ : উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কন্যারা তিনভাবে মাতাপিতার সম্পত্তি পেতে পারে। একমাত্র কন্যা হলে তিনি রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ বা (১/২) অংশ পাবে। একাধিক মেয়ে হলে সবাই মিলে সমানভাগে তিন ভাগের দুই ভাগ বা (২/৩) অংশ পাবে। যদি পুত্র থাকে তবে পুত্র ও কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হবে ২:১ অর্থাৎ এক মেয়ে এক ছেলের অর্ধেক অংশ পাবে। যাহোক কন্যা কখনো মাতাপিতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় না
পিতা মারা গেলে তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় যে সম্পত্তি পেতেন তা তার মৃত্যুর পরও তার উত্তরাধিকারীরা পাবে ।
১৯৬১ সালের আগে এই নিয়ম ছিল না। পরে একটি আইন পাস করে এই নিয়ম চালু করা হয়। কারণ এতিমরা যাতে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয় সেই সম্পর্কেও ইসলামে নির্দেশ দেয়া আছে। আবার মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কোন সন্তানকে ত্যাজ্য বলে ধরা হয় না। ফলে সম্পত্তি থেকে তাকেও বঞ্চিত করা যায় না। তবে কোন ব্যক্তি রেজিস্ট্রিকৃতভাবে সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর করে গেলে এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সন্তানের অংশ উল্লেখ না করে গেলে ঐ সন্তান আর সম্পত্তি পাবে না। সৎ ছেলে-মেয়ে, সৎ বাবা বা সৎ মায়ের সম্পত্তি পায় না ।
 একই ভাবে সৎ বাবা বা সৎ মা, সৎ ছেলে-মেয়ের সম্পত্তি পায় না। কেউ কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারী তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে কেউ কারো সম্পত্তি পাবে না। জারজ সন্তান তার মা ও মায়ের আত্নীয়দের থেকে সম্পত্তি সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পাবে (মুসলিম হানাফী আইন অনুসারে) ।
মৃত ব্যক্তির কোন উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তা তিনি জীবিতকালে কাউকে না দেয়ার ব্যবস্থা করে গেলে সরকার তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে। উত্তরাধিকার সম্পর্কে উপরোক্ত সাধারণ কয়েকটি বিষয় মনে রাখলে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের জটিলতা দূর হবে ।
 

 

 

ভালো লাগলে পোস্টটি শেয়ার করুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url