ভূমি উন্নয়ন কর কি?
ভূমি উন্নয়ন কর |
প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকরা জমির নিরঙ্কুশ মালিকানা দাবি ও ভোগদখল করার জন্য কৃষকগণ জমির খাজনা প্রদান করে আসছেন ৷ তখনকার সময় খাজনা পরিশোধ করা হতো উৎপাদিত ফসল দিয়ে ৷ অতঃপর ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ ১৯৭৬ সালে খাজনা শব্দটি বাদ দিয়ে ভূমি উন্নয়ন কর বলা হয় ৷ এই ভূমি উন্নয়ন কর-ই হলো খাজনা ৷ যা বর্তমানে অনেকেই ভূমির খাজনা হিসেবে জানি ৷
ভূমির বাৎসরিক এই কর বা খাজনা বাংলা সন অনুয়াযী আদায় করা হয় ৷ তাই বছরে একবার ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে হয়৷
ভূমি উন্নয়ন কর কি?
ভূমির মালিকগণ নিজের জমি ব্যবহার ও ভোগদখল করার জন্য সরকারকে প্রতি শতাংশ জমির জন্য বাৎসরিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কর হিসেবে পরিশোধ করতে হয় ৷ আর এই কর পরিশোধ করাটাই হলো ভূমি উন্নয়ন কর
ভূমি উন্নয়ন কর কোথায় পরিশোধ করতে হয়?
ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করার জন্য প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে এলাকা ভিত্তিক ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ভূমির মালিকগণ তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে একটি রশিদ গ্রহণ করে থাকবেন আর রশিদ কে বলা দাখিলা বা খাজনার রশিদ
দাখিলার গুরুত্ব
খাজনার রশিদ বা দাখিলা জমির মালিকানা প্রমাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা দিয়ে ভূমির নামজারী, বেচা-কেনা এবং আরো অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ৷
খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া হলে করণীয়
ভূমি উন্নয়ন কর সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা না থাকায় অনেকেরই বছরের পর বছর এই কর বকেয়া পড়ে থাকে ৷ এই কর বছরে একবার পরিশোধ করতে হয় ৷ কর বকেয়ার ফলে হতে পারে রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা সহ অনেক অনেক সমস্যা, এমনকি জমির মালিকানাও হারাতে হতে পারে ৷ তবে- এখানে ভুল ধারনা হলো তিন বছরের বেশি বকেয়া থাকলে তা আদায় করা যায় না,
এমনটা ভুল ধারনা৷ বিধিমালা বিষয়টি স্পষ্ট করছে তিন বছররর মধ্যে আদায়ের জন্য রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করতে হয় ৷ এর মাধ্যমে জমি নিলামে বিক্রি করা হয় ৷ এমনকি সরকার সেই জমি খাস জমি হিসেবে ক্রয় করে ভূমিহীনদের মাঝে বন্টন করে দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন ৷
এজন্যই বাৎসরিক ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা প্রয়োজন৷ যে বছরের কর বকেয়া থাকবে সেই বছরের ৬.২৫ হারে কর আদায় করা হয়ে থাকে ৷
দলিলের রশিদ হারিয়ে গেলে করণীয় কি ?
মৃত স্ত্রীর জমি হইতে স্বামীর প্রাপ্ত হিস্যা
খাজনার কর পরিশোধের হার
বাংলা ১৩৭৯ সন হতে ভূমির খাজনা ধার্য করা হয় ৷ ইংরেজী ২০১৫ সাল থেকে ভূমি মন্ত্রনালয় কর্তৃক আদেশকৃত হারে খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে হয় ৷
এর আগে বাংলা ১৩৮২ সন পর্যন্ত কোন পরিবারের ২৫ বিঘা বা তার উর্দ্ধে জমির জন্য খাজনা ও শিক্ষা কর ছিল। ২৫ বিঘার কম জমির জন্য শুধু শিক্ষা কর দিতে হতো। বাংলা ১৩৮৩ সন (ইংরেজী ১৯৭৬ সাল) থেকে বাংলা ১৩৮৮ সন পর্যন্ত ২৫ বিঘা পর্যন্ত বিঘা প্রতি (৩৩ শতাংশ) জমির জন্য ৯০ পয়সা ও ২৫ বিঘার উর্দ্ধে বিঘা প্রতি ০৫ টাকা খাজনা ছিল। বাংলা ১৩৮৯ সন থেকে বাংলা ১৩৯৩ সন পর্যন্ত ০২ একর জমির জন্য শতাংশ প্রতি ৩ পয়সা, ০২ একর থেকে ০৫ একর পর্যন্ত জমির জন্য প্রথম দুই একরের জন্য ৬ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ১৫ পয়সা। ০৫ একর থেকে ১০ একর পর্যন্ত জমির জন্য প্রথম ০৫ একরের জন্য ৫১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ৩৬ পয়সা। ১০ একর হতে ১৫ একর পর্যন্ত প্রথম ১০ একরের জন্য ২৩১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ৬০ পয়সা। ১৫ একর থেকে ২৫ একর পর্যন্ত প্রথম ১৫ একরের জন্য ৫৩১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ৬০ পয়সা। ২৫ একরের উপর হলে প্রথম ২৫ একরের জন্য ১৪৮১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ১ টাকা ৪৫ পয়সা।
এবং বাংলা ১৩৯৪ সন (ইংরেজী ১৯৮৭ সাল) থেকে বাংলা ১৪০১ সন (ইংরেজী ১৯৯৪ সাল) পর্যন্ত দুই একর জমির জন্য শতাংশ প্রতি ৩ পয়সা, সব মিলিয়ে এক টাকার কম নয়। ২ একর থেকে ৫ একর পর্যন্ত জমির জন্য শতাংশ প্রতি ৩০ পয়সা। ৫ একর থেকে ১০ একর পর্যন্ত শতাংশ প্রতি ৫০ পয়সা। ১০ একরের বেশি জমি হলে শতাংশ প্রতি ২ টাকা। বাংলা ১৩৯৮ সনের ১ বৈশাখ থেকে ২৫ বিঘা বা ৮.২৫ একর পর্যন্ত কৃষি জমির ওপর থেকে সকল ধরনের কর প্রত্যাহার করা হয়।
মুসলিম ফারায়েজ আইন
ভূমি উন্নয়ন করের হার বর্তমানে প্রচলিত :
বর্তমানে ২০১৫ সাল থেকে ভূমি মন্ত্রনালয়ের ধার্য হার অনুযায়ী ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করতে হয় ।
কৃষি জমির ক্ষেত্রে:
ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ ২৫ বিঘা পর্যন্ত। ২৫ বিঘা হতে ১০ একর পর্যন্ত জমির জন্য প্রতি শতাংশ জমির জন্য ২ টাকা। বাগানের ক্ষেত্রে চাবাগান, রাবার বাগান, আমবাগান অথবা ১ একরের উধ্বে কোনো জমিতে ফলের বাগান কিংবা ফুলের বাগান থাকলে জমির ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ জমির জন্য ১ টাকা ১০পয়সা।
আবাসিক জমি পল্লী এলাকার ক্ষেত্রে:
ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০ সালের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পল্লী এলাকার বসবাসকারী কৃষি পরিবারের চাষের জমি এবং বসত বাড়ী কৃষি জমি হিসাবে গন্য করে কৃষি হারে ভূমি উন্নয়ন কর ধার্য হবে। তবে পল্লী এলাকার পাকা ভিটির বাড়ীর জন্য শতক প্রতি ১০ টাকা হারে কর দিতে হবে।
পরিশোধের পদ্ধতি:
বাংলা সনের মধ্যেই ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে। তবে ১ বছরের বকেয়া হলে সংশ্লিষ্ট বাংলা সনের ৩০শে চৈত্রের পরই উক্ত কর বকেয়া বলে গন্য হবে এবং মূল পাওনাকৃত করের সাথে ৬.২৫ হারে সুদ যোগ হবে এবং যত বছরের কর বাকী থাকবে ততগুন সুদ বেশী হবে এবং মূল করের সাথে যুক্ত হবে যেক্ষেত্রে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয়না ।
খতিয়ান ও পর্চা কি ?
ভূমির বিবরণ দাখিলে বাধ্য বাধকতা:
রাষ্ট্রীয়অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৫১ ধারার ডি উপধারা অনুযায়ী কোনোকৃষি জমির মালিকের ২৫ বিঘার বেশী কৃষি জমির মালিক হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নিকট জমির বিবরণ দাখিল করতে বাধ্য থাকেন। আইনের ১৫১(ই) ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি ২৫ বিঘার বেশী কৃষিজমির মালিক হলে এবং উক্ত জমির বিবরনী দাখিল না করলে কিংবা ইচ্ছাকৃত ভাবেজমির তথ্য গোপন করলে তাকে ১০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে ৷ ১৫১ (এইচ) ধারাঅনুযায়ী বিবরনী বহির্ভূত জমি সরকার বরাবরে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। কারোমালিকানায় ২৫ বিঘার বেশি সম্পত্তি রয়েছে মর্মে সন্দেহ হলে সহকারী কমিশনার(ভূমি) উক্ত আইনের ৭৪(১) ধারা অনুযায়ী বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিশ দিতেপারেন। অবাধ্য হলে দন্ডবিধির ১৭৫ ও ১৭৬ ধারা অনুয়ায়ী দন্ডনীয় অপরাধে অপরাধীহবেন।
জমির বিবরণী কমিয়ে আনতে করণীয়:
বিবরণী দাখিলকারীর মৃত্যু অথবা জমি বিক্রয়, দান ওয়াকফ ইত্যাদির ফলে অথবা কোনোভাবে জমি হস্তান্তরের ফলে জমির পরিমাণ ২৫ বিঘার নীচে নেমে গেলে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৫১ ধারার (আই) উপ-ধারা মতে জমির মালিক অথবা তার উত্তরাধিকারীগণ সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নিকট ২৫ বিঘা জমিরবিবরণী কমিয়ে আনার জন্য তথা বিবরনী ভাংগার জন্য আবেদন করবেন। ১লা কার্তিকের পূর্বে আবেদন করতে হবে। উক্ত আবেদন পাবার পর সহকারী কমিশনার(ভূমি) প্রয়োজনীয় তদন্ত এবং শুনানীর ব্যবস্থা করে যথাযথ মনে করলে বিবরণীসংশোধন বা ভাংগার বা বিবরণী কমিয়ে আনার আদেশ দিবেন। আবেদনটি যদি মঞ্জুর হলেউক্ত আদেশটি ১লা কার্তিক হতে কার্যকর হয়। এজন্য পূর্বের বছরগুলোর করেরসঙ্গে প্রথম ৬ মাসের কর পরিশোধ করতে হবে। আর কার্তিক মাসের পর আবেদন করলে চলমান পুরো বছরের কর পরিশোধ করতে হবে।
তবে জমির পরিমাণ ২৫ বিঘার নীচে নেমে গেলেও তা কর্তৃপক্ষকে না জানানো পর্যন্ত জমির মালিককে ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা পূর্বের বিবরণী মোতাবেকই দিতে হবে। অনেক কৃষি জমির মালিকই কর মওকুফের সুবিধা লাভের আশায় প্রতারণামূলক জমি বন্টন করে জমি ২৫বিঘার নীচে কমিয়ে আনলেও আইনগত ভাবে কর বা খাজনা মওকুফের সুবিধা পাওয়া যাবেনা। বিবরণভুক্ত কোনো মালিকের জমি কেউ ক্রয় করলে
ক্রেতাকে তার নিজের নামে উক্ত জমির নামজারি করে আলাদা না করা পর্যন্ত ক্রেতাকে পূর্বের বিবরণী মোতাবেকই উক্ত জমির খাজনা প্রদান করতে হবে। উত্তারাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির বিবরণী ভাঙতে হলে ওয়ারিশদের মধ্যে আপোষ বণ্টনপূর্বক তা রেজিস্ট্রিকরে আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এছাড়াও বিবরণীভুক্ত জমি কেনার আগে ঐজমির ভূমি উন্নয়ন কর বাকী আছে কিনা তা যাচাই করে নেয়া দরকার। এছাড়া বড়অংকের ভূমি উন্নয়ন করের সম্মুখীন হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রতিকারের জন্য কোথায় যেতে হবে?
বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা তহশিলদার ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করে থাকেন।আগেই বলা হয়েছে-এরা কোন অসৎঅর্জনের জন্য বেশি কর ধার্য করলে অথবাএতদসংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে সমস্যা সৃষ্টি হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এরসঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। দাবি সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)অথবা জেলা প্রশাসক এর কাছে ১৫ দিনের মধ্যে আপত্তি দাখিল করতে হবে। জেলা প্রশাসকের আদেশে কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে ৪৫দিনের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপিল করা যাবে। বিভাগীয় কমিশনারেরআদেশে কোন ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে সেই আদেশের বিরূদ্ধেও ১৫ দিনের মধ্যেভূমি আপিল বোর্ডের কাছে আপিল করা যাবে।
বর্তমানে সরকার ভূমি সেবা আরো সহজ এবং হয়রানিমুক্ত করার জন্য নামজারির মতো অনলাইনেও ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষে কাজ চলমান আছে। সরকারের রাজ্বস বাড়ানোর জন্য যেমন ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের হার বাড়ানো দরকার তেমনি সাধারণ মানুষকে নিজের জমির মালিকানা এবং দখল নিশ্চিত করার জন্য স্বেচ্ছায় ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানে আগ্রহী হতে হবে।