হিন্দু উত্তরাধিকার আইন দায়ভাগ মতবাদ
হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার সম্পর্কে প্রচলিত পদ্ধতি বা মতবাদ দুইটি যেমনঃ
(ক) মিতাক্ষরা মতবাদ (খ) দায়ভাগ মতবাদ, বাংলাদেশে প্রযোজ্য হলো দায়ভাগ মতবাদ
দায়ভাগ এর মতে উত্তরাধিকারের যোগ্য শ্রেনীবিভাগ তিনটি যথাঃ
(১) সপিন্ড, (২) সকূল্য, (৩) সমানোদক
(১) সপিন্ড (পিন্ড দানকারী):
সপিন্ডগন প্রথম শ্রেণীর ওয়ারিশ হয়ে থাকেন । দায়ভাগ এর মতে সপিন্ড বলা হয় দুই ধরণের ব্যাক্তিকে । যখন তারা একই অন্তোষ্টিক্রিয়া বা শ্রাদ্ধপাঠের দ্বারা সম্পৃক্ত হয় । এই দুই ব্যাক্তির মধ্যে একজন অপরজন কে পিন্ড দান বা গ্রহণের অধিকারী হলে তখন ঐ ব্যাক্তিদেরকে সপিন্ড বলা হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে পুরুষ ৪৮ জন, নারী ০৫ জন ( বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী) মোট ৫৩ জন৷
আবার ০৫ জন নারী সপিন্ড জীবনস্বত্বে মালিক৷ জীবন স্বত্বে মালিকগণ Legal necessity মর্মে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন৷
মৃত ব্যক্তির উর্ধ্বকূলে তিন কূল এবং নিম্নদিকে কূল সপিন্ড৷
১-৩: পুত্র, পৌত্র এবং প্রপৌত্র ( সর্বাগ্রে এবং একসঙ্গে উত্তরাধিকারীস্বত্বের দাবিদার) ৷
৪: বিধবা স্ত্রী, পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের পুত্রের স্ত্রী,
( ১-৩ জীবিত থাকলে এক পুত্রের সমান নতুবা সম্পূর্ন অংশ জীবনস্বত্বের অধিকারী৷ ১- ৪ নং ক্রমিকের ব্যক্তিগণ একত্রে মৃতের সম্পত্তি পেতে পারে ৷ বিধবা স্ত্রী যেরুপ অংশ পায়, পুত্রের স্ত্রী বা ঐ শ্রেনীর বিধবাগণও অনুরুপ অংশ পায়৷ ) পুনঃবিবাহ হলে বিধবাগণ বঞ্চিত হন ।
একাধিক বিধবা স্ত্রী থাকলে তারা মৃত স্বামীর ত্যাক্ত সম্পত্তিতে একই সঙ্গে সহ- উত্তরাধিকারী হবে এবং একজন বিধবার মৃত্যু হলে অপর বিধবা সেই অংশ পাবে । বিধবাদের মৃত্যুর পর স্বামীর নিকটতম আত্মীয়দের নিকট তাদের প্রাপ্ত সম্পত্তি ফিরে যাবে (রিভার্শনার)
৫ : কন্যা (অবিবাহিত কন্যা -- পুত্রবতী/পুত্রসম্ভবনা) । বন্ধ্যা কন্যা
বন্ধ্যা কন্যা/ পুত্র সন্তানহীন বিধবা কন্যা/ পুত্র সন্তাহীন কিন্তু কন্যা সন্তানের মাতা এমন কন্যা বঞ্চিত ৷
৬: কন্যার পুত্র
৭: পিতা
৮: মাতা
৯: ভাই (i) সহোদর ভাই (অগ্রাধিকার), (ii) বৈমাত্রের ভাই
১০: ভাইয়ের ছেলে (i) সহোদর ভাইয়ের ছেলে (অগ্রাধিকার) (ii) বৈমাত্রের ভাইয়ের ছেলে
১১: ভ্রাতুষ্পুত্রের ছেলে (i) সহোদর ভাইয়ের ছেলের ছেলে (অগ্রাধিকার) (ii) বৈমাত্রের ভাইয়ের ছেলে
১২: বোনের ছেলে
১৩: পিতামহ
১৪: পিতামহী
১৫: খুড়ো বা জেঠা
১৬: খুড়ো বা জেঠার ছেলে
১৭: খুড়ো বা জেঠার ছেলের ছেলে
১৮: পিতার বোনের ছেলে
১৯: প্রপিতামহ
২০: প্রপিতামহী
২১: পিতামহের ভাই
২২: পিতামহের ভাইয়ের ছেলে
২৩: পিতামহের ভাইয়ের ছেলের ছেলে
২৪: পিতার পিতার বোনের ছেলে
**৮ জন ভিন্নগোত্রীয় সপিন্ড একাধিক্রমে উত্তরাধিকার লাভ করে**
২৫: পুত্রের কন্যার ছেলে
২৬: পুত্রের পুত্রের কন্যার ছেলে
২৭: ভাইয়ের কন্যার পুত্র
২৮: ভাইয়ের ছেলের কন্যার ছেলে
২৯: খুড়ো বা জেঠার কন্যার ছেলে
৩০: খুড়ো বা জেঠার ছেলের কন্যার ছেলে
৩১: পিতার খুড়ো বা জেঠার মেয়ের ছেলে
৩২: পিতার খুড়ো বা জেঠার ছেলের মেয়ের ছেলে
**মৃতের মাতৃকুলের বা ভিন্নগোত্রীয় সপিন্ডগণের অগ্রাধিকারঃ **
৩৩: মাতামহ
৩৪: মামা
৩৫: মামার ছেলে
৩৬: মামার ছেলের ছেলে
৩৭: মায়ের বোনের ছেলে
৩৮: প্রমাতামহ
৩৯: প্রমাতামহের ছেলে
৪০: প্রমাতামহের পৌত্র
৪১: প্রমাতাহের প্রপৌত্র
৪২: প্রপ্রমাতাহের কন্যার ছেলে
৪৩: প্রপ্রমাতামহ
৪৪: প্রপ্রমাতামহের পুত্র
৪৫: প্রপ্রমাতামহের পৌত্র
৪৬: প্রপ্রমাতামহের প্রপৌত্র
৪৭: প্রপ্রমাতামহের কন্যার পুত্র
৪৮: মাতামহের পুত্রের কন্যার পুত্র
৪৯: মাতামহের পুত্রের পুত্রের কন্যার পুত্র
৫০: প্রমাতামহের পুত্রের কন্যার পুত্র
৫১: প্রমাতামহের পুত্রের পুত্রের কন্যার পুত্র
৫২: প্রমাতামহের পুত্রের কন্যার পুত্র
৫৩: প্রমাতামহের পুত্রের পুত্রের কন্যার পুত্র
০১-০৪ ক্রমিকের ব্যক্তি সম্পত্তি পেলে পরবর্তী ক্রমিকের ব্যক্তি সম্পত্তি পাবে না ৷ এভাবে মোট ৫২ জনের অনুপস্থিতিতে ৫৩নং ব্যক্তি সম্পত্তি পায়৷ যদি ৫৩নং ব্যক্তি জীবিত না থাকে তবে সকুল্য উত্তরাধিকারীগণ সম্পত্তি পায়
(২) সকুল্য (পিন্ডলেপ দানকারী)
৩৩ জন পুরুষ- সপিন্ডের উর্ধ্বকুলে ৩ (তিন) কুল এবং সপিন্ডের নিম্ন দিকে ৩ (তিন) কুল সকুল্য ৷
(ক) পিতৃকুলের ৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ঠ, উর্ধ্বতন পুরুষ (পিতা-৪, পিতা-৫, পিতা-৬) = ৩জন
(খ) ৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ঠ অধঃস্তন পুরুষ বংশধরগণ (পুত্র-৪, পুত্র-৫, পুত্র-৬)= ৩জন
(গ) পিতৃকুলের ৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ঠ উর্ধ্বতন পুরুষের পুরুষানুক্রমিক ৬জন করিয়া পুরুষ, বংশধরগণ (পিতা-৪, পিতা-৫, পিতা-৬ এর লাইনের সহিত পুত্র-১, পুত্র-২, পুত্র-৩, পুত্র-৪, পুত্র-৫, পুত্র-৬ = ৩×৬ মোট ১৮ জন এবং তাহার পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহের পুরুষানুক্রমিক ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ পুরুষ বংশধর (পিতা-১, পিতা-২, পিতা-৩ এর লাইনের সহিত পুত্র-৪, পুত্র-৫, পুত্র-৬= ৩×৩ মোট ৯জন, মোট সকুল্য সংখ্যা ৩+৩+২৭= ৩৩ জন
**সকুল্যের কেউ জীবিত না থাকলে সমানোদক শ্রেণীর ব্যক্তিরা সম্পত্তি পায়ঃ**
(৩) সমানোদক (জল সিঞ্চনকারী)-
১৪৭জন পুরুষ, ৮ম হইতে ১৪ দশ পর্যায়ের সকল সগোত্রীয় আত্মীয় ৷ সকুল্যের উর্ধ্বে ৭ (সাত) কুল এবং নিম্নে ৭ (সাত) কুল ৷
মৃত ব্যক্তিসহ উর্ধ্বে ১৪ (চৌদ্দ) পুরুষ এবং নিম্নে ১৪ (চৌদ্দ) পুরুষ পর্যন্ত সম্পত্তি পেতে পারে ৷
স্ত্রীধনের উত্তরাধিকারঃ বিবাহিত নারীর স্ত্রীধন-১ বৈপিত্রেয় বা সহোদর ভ্রাতা, ২, মাতা, ৩, পিতা, ৪, পিতার নিকটতম উত্তরাধিকার, ৫, মাতার নিকটতম উত্তরাধিকার,
বিভিন্ন প্রকার স্ত্রীধনের উত্তরাধিকারঃ কঃ শুল্ক, ১- সহোদর ভাই, ২- পিতা, ৩- মাতা, ৪- স্বামী ৷
খঃ যৌতুক, ১- কুমারী মেয়ে, ২- বাগদত্তা মেয়ে ৩- পুত্রবতী মেয়ে, ৪- বিবাহিত কন্যা, ৫- পুত্র, ৬- দৌহিত্র, ৭- পুত্র, ৮- প্রপৌত্র, ৯- সৎ পুত্র, ১০- সৎ পুত্রের পুত্র,১১- সৎ প্রপৌত্র ৷
** অনুমোদিত বিবাহে যৌতুকের উত্তরাধিকার: ১- মাতা, ২- পিতা, ৩- স্বামী, ৪- ভ্রাতা, ৫- স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা, ৬- স্বামীর ভ্রাতুষ্পুত্র, ৭- ভাগিনা, ৮- স্বামীর ভাগিনা, ৯- ভ্রাতুষ্পুত্র, ১০- মেয়ের স্বামী ১১- স্বামীর সপিন্ড ও সমানোদক, ১২- পিতার জ্ঞাতী ৷
গঃ অযৌতুকঃ ১- পুত্র এবং কুমারী মেয়ে (একত্রে সমান অংশ) ২- বিবাহিত পুত্র সন্তানসম্ভাবনা নারী, ৩- পুত্র, ৪- দৌহিত্র, ৫- বন্ধ্যা বিবাহিত কন্যা এবং সন্তানহীনা মেয়ে, ৬- মাতা, ৭- পিতা, ৮- স্বামী, ৯- স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা, ১০- স্বামীর ভ্রাতুষ্পুত্র, ১১- ভাগিনা, ১২- স্বামীর ভাগিনা, ১৩- ভ্রাতুষ্পুত্র, ১৪- মেয়ের জামাই, ১৫- স্বামীর সপিন্ড, সকুল্য ও সমানোদক, ১৬- পিতার জ্ঞাতি ৷
ঘ, অন্বাধায়কঃ ১- অবিবাহিত মেয়ে, ২- পুত্র, ৩- বিবাহিত মেয়ে, ৪- স্বামী, ৫- ভাই, ৬- মাতা, ৭- বাবা ৷
• নিঃসন্তান অবস্থায় অন্ব্যাধায়কের উত্তরাধিকারী- ১. ভাই, ২. মাতা, ৩. পিতা, ৪. স্বামী ।
* উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ : ক) অসতীত্ব খ) জাতিচ্যুতি ও ধর্মান্তর (১৯৭৩ সনের ৮নং আইন) তবে সম্পত্তি পাওয়ার পরে জাতিচ্যুতি ও ধর্মান্তর হলে প্রযোজ্য নয় ৷
গ) হত্যার কারণে (উত্তরাধিকারী সহ)
ঘ) সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ
ঙ) পিতার প্রতি শত্রুতা
চ) অন্ধ, বধির, বোবা ও কানা ব্যক্তি
ছ) অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হানী
জ) মস্তিস্ক বিকৃতি, চৈতন্যহীন
ঝ) হাবাগোবা, নির্বোধ
ঞ) কুষ্ঠ রোগী
ট) অন্যান্য দূরারোগ্য ব্যাধি
ঠ) পুরুষত্বহীন
ড) বিধবা কর্তৃক পুনবিবাহ
* যে সকল কারণে কোন হিন্দু সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় ৷ সে সকল কারণ ঘটার পূর্বেই যদি সে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তীতে সে সেই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না ৷
* কোন হিন্দু যদি হত্যাকারী বলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে বঞ্চিত হয় তবে ধরে নেওয়া হবে যে, ঐ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটছে, তার ওয়ারিশগণও সে সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে বঞ্চিত হবে ৷
* Legal necessity বা বৈধ প্রয়োজন সমূহঃ
ক, অন্তোষ্টিক্রিয়া এবং শ্রাদ্ধাদি কাজে ব্যয়
খ, আধ্যাত্মিক মঙ্গলার্থে ব্যয়
গ, অবশ্য করণীয় কার্য বাবদ ব্যয়
ঘ, মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ
ঙ, Letters of Administration/ Succession Certification সংগ্রহ বাবদ ব্যয়,
চ, রাজস্ব পরিশোধ
ছ, ভরণ পোষন বাবদ ব্যয়
জ, বিবাহ বাবদ ব্যয়
ঝ, যৌতুকাদি দেয় বাবদ ব্যয়
ঞ, ব্যবসা চালু রাখতে ঋণ পরিশোধ
ট, সম্পত্তির উপকারার্থে প্রয়োজনীয় ব্যয়
ঠ, ধর্মীয় ও জনকল্যাণ মূলক ব্যয়
ড, মৃত ব্যক্তির অসম্পূর্ণ জনহিতকর কাজ সম্পূর্ণ করার ব্যয় ৷
* হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ৷
* হিন্দু আইনে যে কয়জন ওয়ারিশ হবে প্রত্যেকে সমান অংশ পাবে ৷
* সপিন্ড, সকূল্য ও সমানোদক উত্তরাধিকারীগণের অবর্তমানে তার ধর্মীয় গুরুর শিষ্য এবং নিজের শিষ্য / চেলা উত্তরাধিকারী হবে ৷ এদের অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তি সরকারের নিকট চলে যাবে ৷
* হিন্দু আইনের স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামী বঞ্চিত ৷ তবে স্ত্রীর মৃত্যুর পর সকল শ্রেণীর উত্তরাধিকারী না থাকলে স্বামী সমস্ত সম্পত্তি পায় ৷
* হিন্দু বিধবা জীবনস্বত্বে মালিকানার পরিবর্তে নিরঙ্কুশ মালিকানা বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের রায় ঘোষিত হয়েছে ৷