জাল দলিল আইন ও প্রতিকার

জাল দলিল আইন ও প্রতিকার

জাল দলিল কি

সম্পত্তির বৈধ মালিকের অজ্ঞাতসারে তার সম্পত্তি প্রতারণার মাধ্যমে নিয়ে নেয়ার জন্য। যে অবৈধ দলিল প্রস্তুত করা হয় এক কথায় তাকে জাল দলিল বলে।

মামলা করবেন কে?

১। দেওয়ানী আদালতে যিনি বা যারা সম্পত্তির বৈধ মালিক তিনি বা তারাই মামলা করবেন 

২। সম্পত্তির মালিক বেঁচে থাকলে ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী মামলা করতে পারবেন না। 

৩। নাবালকের সম্পত্তি জাল দলিল হলে ঐ নাবালকের অভিভাবক মামলা করবেন ।

জাল দলিল মামলা কখন করবেন:

সমস্ত আইনের ১ম তফসিলের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুসারে জাল দলিল তৈরি হলে এব্যাপারে ৩ বছরের মধ্যে দায়ের করতে হবে। যত দ্রুত করা যায় ততই ভালো।

জাল দলিল মামলার ফি:

১। দলিল বাতিলের মামলা করার জন্য কোর্ট ফি আইনের দ্বিতীয় তফসিলে ১৭(৩) অনুচ্ছেদ উল্লেখিত হারে কোর্ট ফি প্রদান করতে হবে।

২। জাল দলিল বাতিলের মামলার সাথে অন্য প্রতিকার যেমন- দখল পাবার প্রার্থনাও করা যাবে। তবে এজন্য কোর্ট ফি আইন ৭(৪) (গ) ধারা মোতাবেক অতিরিক্ত কোর্ট ফি

জাল দলিলের জন্য মামলা করার বিধানাবলি:

১। দেওয়ানি আদালতের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ৩৯ ধারায় জাল দলিল রেজিস্ট্রি বাতিলের মামলা করা যাবে।

২। ফৌজদারী আদালতে দলিল জালকারীর শাস্তি দাবি করে দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/ ৮৬৩-৪৭৩ ধারায় মামলা করা যাবে।

৩। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ৪০ ধারায় জাল দলিলের আংশিক বাতিলের মামলা করা যাবে।

৪। তামাদি আইনের ১ম তফসিলের ৯১নং অনুচ্ছেদ অনুসারে মামলা করা যাবে।

৫। নাবালকের জমি জাল দলিলের মাধ্যমে নিয়ে নিলে ক্ষতিগ্রস্থ নাবালক ২১ বছর পূর্ণ হলে বা তার অভিভাবক জাল দলিল হয়েছে বলা মাত্রই মামলা করতে পারবেন। নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনত অবৈধ।

৬। যিনি কোনো দলিলকে জাল বা অন্যায়ভাবে সম্পাদিত বলে দাবি করবেন তাকেই সাক্ষ্য আইন ১০১ ধারা ২৬ ডি এল আর ৩৯২ এ তার দাবির পক্ষে সত্যতা প্রমাণ করতে হবে । 

৭। জাল দলিল বাতিল না হলে যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তিনি এ মামলা করতে পারবেন।

৮। একাধিক ব্যক্তি বা পক্ষ হলে তাদের সবাই বা পক্ষে একজন মামলা করতে পারবেন ।

৯। সাক্ষ্য আইন ১০১ ধারা ২৬ ডি এল আর ৩৯২ ধারা মতে যিনি জাল দলিল এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত তাকেই তার পক্ষে সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।

জমিজমার আইন

ফলাফল পরবর্তী অবস্থা। জাল দলিল বাতিলের জন্য সিভিল কোর্ট বা দেওয়ানী আদালতে মামলা করার ৯০ দিনের মধ্যে আদালত যদি আপনার দলিল ও অন্যান্যা প্রমাণাদী পর্যবেক্ষণ করে সন্তুষ্ট হন তাহলে জাল দলিল বাতিলের আদেশ দিয়ে রায় প্রদান করবেন। 

আদালতে রায়ের ১ কপি সংশ্লি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রেরণ করবেন। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস আদালতের আদেশ অনুযায়ী জাল দলিল বাতিলের বিষয়াটি রেজিস্ট্রি বহিতে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।

ভুল দলিল সংশোধন:

দলিলে ভুল চোখে পড়ার পর তা সংশোধনের জন্য তিন বছরের মধ্যে সিভিল কোর্ট দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হবে। তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলে এরপর মামলা তামাদির দ্বারা বাতিল হয়ে যায়। তখন আর মামলা করা যায় না। 

তখন এ সমস্যা সমাধান করার জন্য আদালতে ঘোষণামূলক মামলা করতে হয়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ৩১ ধারা অনুযায়ী এরূপ ঘোষণামূলক মামলার রায়ই সংশোধন দলিল হিসাবে গন্য হবে উক্ত রায়ের কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রেরণ করার পর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস আদালতের রায় অনুযায়ী রেজিস্ট্রার বহিতে ভুল সংশোধন করে নিবেন। এই জন্য নতুন করে দলিল করার প্রয়োজন হয় না।

দলিল সংশোধন প্রসঙ্গে

OF THE RECHIFICATION OF INSTRUMENTS দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা যদি কোনো পক্ষসমূহের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুলের কারণে দলিলটিতে ভুল দেখা দেয় অর্থাৎ পক্ষসমূহের দলিল সম্পাদনের সময়ের যে উদ্দেশ্য ছিল তা ব্যাহত হয় তবে যে কোনো পক্ষ দলিল সংশোধন মোকাদ্দমা করতে পারবেন। মামলার ধারাসমূহ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারা ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ নিচে দেয়া হলো।

৩১। যখন দলিল সংশোধন করা যাইতে পারে।

যখন প্রতারণার মাধ্যমে অথবা পক্ষসমূহের পারস্পরিক ভুলের দরুন কোনো চুক্তি বা অপর কোনো লিখিত দলিল সত্যিকারভাবে তাহাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে না, যে কোনো পক্ষ অথবা তাহাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি দলিল সংশোধিত করিয়া লইবার জন্য মামলা দায়ের করিতে পারে 

এবং যদি ইহা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হইয়াছে বলিয়া আদালত দেখিতে পায়। যে, দলিল প্রণয়নের সময় প্রতারণা বা ভুল করা হইয়াছে এবং তাহা কার্যকর করিবার ব্যাপারে পক্ষসমূহের সত্যিকার উদ্দেশ্য নিরূপণ করিতে সক্ষম হন, সেখানে আদালত তাহার বিবেচনামূলক ক্ষমতাবলে যতদূর পর্যন্ত তাহা তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক সরল বিশ্বাসে এবং মূল্যের বিনিময়ে অর্জিত অধিকারে হস্তক্ষেপ না করিয়াই করা যায়, ততদূর পর্যন্ত দলিল সংশোধন করিতে পারে, যাহাতে সেই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিতে সক্ষম হয়।

সংক্ষিপ্ত বিবরণ (Synopsis)

(১) আওতা: (২) পক্ষগণের প্রকৃত উদ্দেশ্য: (৩) পারস্পরিক ভুল: (৪) প্রমাণের দায়িত্ব: (৫) বিলম্ব: (৬) আপসে নিস্পত্তি হওয়া ডিক্রী: (৭) ফেরত দলিল: (৮) তামাদি: (৯) ঘোষণামূলক মামলা:

(১) আওতা : প্রতারণার মাধ্যমে অথবা পক্ষসমূহের পারস্পরিক ভুলের দরুণ কোনো চুক্তি বা অপর কোনো লিখিত দলিল সত্যিকারভাবে তাহাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত না করিলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারার আওতাধীন দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যায় এবং আদালত যদি দেখিতে পায় যে, দলিলটি সত্যই পক্ষগণের উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করিতে ব্যর্থ হইয়াছে তখন এই ধারাবলে ইহা দলিল সংশোধনের ডিক্রী মঞ্জুর করিতে পারে।

দলিল বাতিলের ডিক্রী দিবার পর আদালতকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারার - বিধান মতে ডিক্রীর একটি কপি সংশ্লিষ্ট উপনিবন্ধক বা জিলা নিবন্ধকের নিকট বালাম বহিতে এ বাতিলের বিষয় লিপিবদ্ধ করিবার জন্য প্রেরণ করিতে হয়। 

কিন্তু দলিল সংশোধনের ডিক্রী হইলে বালাম বহিতে লিপিবদ্ধ করিবার কোনো বিধান ২৯ (২) ধারা মতে নিবন্ধনের জন্য সংশ্লিষ্ট উপনিবন্ধক বা জিলা নিবন্ধকের নিকট উপস্থাপন করিতে পারেন। 

এই নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নহে। তবে এই বিষয়ে মহামান্য আদালতের অভিমত এই যে, যে ক্ষেত্রে একটি দলিল সংশোধিত হয় সে ক্ষেত্রে আদালতের আদেশই যথেষ্ট এবং নতুন দলিল মুসাবিদা করিবার কোনো প্রয়োজন নেই। যে দলিল সংশোধিত হইয়াছে উহার উপর আদালতের অদেশের অনুলিপি পৃষ্ঠাজন করিতে হইবে "(White vs. White 42 LJ. Ch. 288)

৩১ ধারার অধীন প্রতিকার পাইতে হইলে উহার ৪টি শর্ত পূরণ করিতে হইবে (41 DLR 519)

(২) পক্ষগণের প্রকৃত উদ্দেশ্য দলিল সংশোধনের মামলায় আদালতকে প্রথমেই দেখিতে হইবে যে, পক্ষগণের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল। লিখিত চুক্তির পর যদি দলিল নিবন্ধনকৃত হয় এবং ঐ দলিলে যদি ভুল থাকে তবে আদালতের পক্ষে লিখিত চুক্তি দেখিয়া দলিল সংশোধনের আদেশ দেওয়া সহজ হয়। 

নিবন্ধনের আগে কোনো লিখিত চুক্তি না থাকিলে অথবা দলিলটি নিজেই যদি চুক্তি হয় তবে আদালতকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মৌখিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া দলিল সংশোধনের ডিক্রী দিতে হইবে। 

উদাহরণ-৩০২ খতিয়ানের ৫১২ দাগের ০.৫০ একর জমির মালিক এজাজ। সে উহা মফিজের নিকট বিক্রয় করিল। দলিলে ভুলক্রমে ৫১২-এর স্থলে ৫২১ দাগ লেখা হইল এবং ঐ অবস্থায় দলিল সম্পাদিত ও নিবন্ধকৃত হইল। 

পরবর্তী সময়ে মফিজ দলিল উঠাইয়া দেখিল যে, দলিলে দাগ নম্বর ভুল লেখা হইয়াছে। মূলত উহা লেখকের ভুল ছিল। খতিয়ান নম্বর এবং জমির পরিমাণ ঠিক লেখা হইয়াছিল এবং ঐ খতিয়ানে ৫২১ দাগ বলিয়া কোনো দাগ নাই। 

সুতরাং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করিলে এই ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, উহ্য পারস্পারিক ভুল ছিল। এই ক্ষেত্রে মফিজ দলিল সংশোধনের মামলা করিলে প্রতিকার পাইবে।

দলিলটি সংশোধনের সময় পক্ষগণের সমবর্তী উদ্দেশ্য কি ছিল তাহা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে বাদী সমর্থ হইলে দলিল সংশোধনের মামলায় উহাই যথেষ্ট (AIR 1949 Bom: 1)।


ভালো লাগলে পোস্টটি শেয়ার করুন

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url